স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত
বাংলার অনন্য কৃতিপুরুষ
যে কালজয়ী কৃতিপুরুষের নামে বিদ্যালয়ের নাম অলংকৃত হয়েছে
পূর্ব বাংলার সর্বপ্রথম ICS অফিসার
বাংলাদেশের যে ক'টি জমিদার বংশ শিক্ষা-দীক্ষা, সমাজ সংস্কার, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি আর আভিজাত্যের চরম শিখরে উঠতে পেরেছিল, নরসিংদী জেলার ভাটপাড়ার গুপ্ত জমিদার বংশটি তাদের মধ্যে অন্যতম। গুপ্ত জমিদার প্রতিষ্ঠার কালপুরুষ ছিলেন মহিন্দ্র নারায়ণ গুপ্ত। ভাটপাড়া এলাকাসহ গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানাধীন কাওরাইদ এবং ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাঁর জমিদারিত্ব। বিত্তবৈভব ও চাকচিক্য থাকলেও নিঃসন্তান হওয়ায় অসুখী ছিলেন মহিন্দ্র নারায়ণ। বংশ রক্ষার জন্য সন্তান দত্তক গ্রহণ করতে মনস্থ করেন ।
অবশেষে মনোহরদী থানার চুলা ইউনিয়নের আকানগর গ্রামের সুধারাম সেন ও যশোদা দেবীর পুত্র কালী নারায়ণ সেন (পূর্ব নাম মাধব চন্দ্ৰ সেন) কে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। দরিদ্র পিতা মাতার ঘরে কালী নারায়ণ সেন (পরে গুপ্ত) ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন । কালী নারায়ণ গুপ্ত কে পিতৃস্নেহে লালন পালন করেন মহিন্দ্র নারায়ণ গুপ্ত । কালী নারায়ণ গুপ্তের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ছিল না তেমন। পিতামহের সহায়তায় নিজ প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞাবলে বাংলা, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। চিন্তার স্বকীয়তা, বিশ্লেষণাত্মক বিচার বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্যমতিত্বের গুণে তিনি একজন প্রাজ্ঞ পন্ডিত হয়েছিলেন। ১৮৬৯ সালে তিনি ব্রাহ্ম ধর্মে দিক্ষিত হন। জমিদার কালী নারায়ণ গুপ্ত এবং স্ত্রী অন্নদাসুন্দরীর কোল জুড়ে এসেছিল ১৬ জন ছেলে মেয়ে। যার মধ্যে ৬ জন শৈশবে মারা যায়। জীবিতদের মধ্যে জ্যৈষ্ঠপুত্র ছিল কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত।
অবিভক্ত ভারতের বাঙালি কৃতিপুরুষ স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি নরসিংদী জেলার ভাটপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি পড়াশোনার প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন। গ্রাম্য টোলেই তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। কে. জি. গুপ্ত ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পোগোজ স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৮৬৬ সালে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা যান। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। অক্সফোর্ডে পড়াশোনাকালীন তিনি অসাধারণ মেধাশক্তির প্রমাণ রাখেন। বাঙ্গালী হয়েও নিজ প্রতিভাবলে ইংল্যান্ডের অনেক প্রতিভাবান ছাত্রদের তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। স্বীয় যোগ্যতা বলে ইংরেজদের মামুলী প্রথা ভেঙ্গে আই. সি. এস. অফিসার হতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনিই ছিলেন ভারতীয় বাঙ্গালীদের মধ্যে সর্বপ্রথম আই. সি. এস. অফিসার। তার এই অবিস্মরণীয় সাফল্য ইংরেজদের শাসনামলে বাঙ্গালীদের অনেক উঁচুতে সমাসীন করেছিল।
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সিপাহী বিদ্রোহকালীন সময়ে বেনিয়া রাজশক্তির নির্মমতা, শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ কে রেঙ্গুনে নির্বাসন সর্বোপরি ব্রিটিশদের দমন পীড়ন নীতি কোন ভাবেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি তিনি । তাই ব্রিটিশদের অধীনে চাকুরী করতে অনীহা বোধ করতেন। এক পর্যায়ে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বিলেতের “লিংকস ইন” এ ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে ব্যারিস্টারি পাশ করেন। তিনি যুগপৎ ইংল্যান্ড ও ভারতে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং বিপ্লবীদেরকে নিঃস্বার্থভাবে আইনি সহায়তা করতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে তাঁর খ্যাতি ব্রিটিশ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তিনি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারতীয়দের সমর্থন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন এবং অচিরেই এই কালজয়ী মহাপুরুষ ইংল্যান্ডের মাটিতে অবিভক্ত ভারতের একজন অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে
সক্ষম হন।
তিনিই একমাত্র প্রথম ভারতীয় ব্যক্তিত্ব, যিনি ইংল্যান্ডের “হাউস অব কমন্স” এর সদস্য নির্বাচিত হওয়ার দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছিলেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়ের ভারতীয় কাউন্সিলরের প্রথম ভারতীয় সদস্য। ব্রিটিশ সরকার এই মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে কে. সি. এস. আই. (Knight Commander Of The Stars Of India) পদকে ভূষিত করেছিলেন। একই সাথে ব্রিটিশ প্রশাসন এই ক্ষণজন্মা ভারতীয় বাঙ্গালী কে “স্যার” উপাধিতে ভূষিত করে।
স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত নারায়ণগঞ্জ জেলার ধুপতারা গ্রামের গুপ্ত পরিবারের প্রসন্ন তারা গুপ্তা (তুফানী গুপ্তা) নামক স্নাতক ডিগ্রীধারী বিদূষী মেয়েকে বিয়ে করেন। তুফানী গুপ্তা ১৮৬৬ সালে কলকাতায় “সখি সমিতি” নামে একটি নারী উন্নয়ন কেন্দ্রিক সামাজিক সংগঠনের গোড়াপত্তন করেন। এ সংগঠনটি ঐ সময় স্ত্রী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ প্রচলন, সহমরণ প্রথা রোধ সহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। লাকসামের জমিদার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী এ সংগঠনের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
স্যার কে. জি. গুপ্ত এবং তুফানী গুপ্তা দম্পত্তির ৪ সন্তান ছিল; শ্রী বীরেন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত, শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত, শ্রী যতীন্দ্র গুপ্ত এবং কন্যা হেম কুসুম গুপ্তা। মেয়ে হেমকুসুম গুপ্তার বিয়ে হয় কে. জি. গুপ্তের ভাগনে উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ, সুরকার, গীতিকার ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেনের সাথে। উল্লেখ্য, স্যার কে. জি. গুপ্তের মামা ছিলেন পবিত্র কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সার্থক বাংলা অনুবাদক মাওলানা ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন।
সার্থক পুরুষ কে. জি. গুপ্তের স্মরণীয় কাজগুলোর একটি হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বাবার নামে কালী নারায়ণ স্কলারশীপ প্রবর্তন । তিনি নিজেই এই বৃত্তির অর্থ যোগান দিতেন। এই স্কলারশীপটি বর্তমানেও চলমান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত সাবসিডিয়ারি ও অনার্স পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীদের এই বৃত্তি প্রদান করা হয়। ১৯১৯ সালে তাঁর নামে পাঁচদোনায় একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় । বাংলা ১৩০০ বঙ্গাব্দে সনে তাদের জমিদারি এলাকায় ব্রাহ্ম সমাজের কল্যাণে তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টায় ও অর্থানুকূল্যে কাওরাইদ কাচারি বাড়ি সংলগ্ন ব্রাহ্ম মন্দিরটি সংস্কার করা হয়। নারী শিক্ষা সম্প্রসারণ, বাল্য বিবাহ রোধ, বহু বিবাহ রোধ, সহমরণ বিরোধী আন্দোলন এবং মূর্তিপূজা বর্জনের মাধ্যমে এক ঈশ্বরের বন্দনা করাসহ সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, কু-প্রথা ও ধর্মীয় গোড়ামির নির্মূলে আত্মনিবেদন করেছিলেন কে. জি. গুপ্ত ও তাঁর পরিবার
স্যার কে. জি. গুপ্ত তাঁর শেষ জীবন কলকাতায় আইন ব্যবসা করে কাটিয়ে দেন। মাঝে মধ্যে ঢাকার লক্ষ্মী বাজারের বাড়িতে থাকতেন। কালেভদ্রে নিজ জন্মস্থান ভাটপাড়া কিংবা কাওরাইদে কাচারিবাড়ি যেতেন। ১৯২৬ সালের ২৯ মার্চ তিনি কলকাতার বালীগঞ্জের নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
“স জাতো যেন জাতেন, যাতি বংশঃ সমুন্নতিম।” যার জন্মে বংশ ও দেশ সমুন্নত হয়, তাঁর জন্মই জন্ম।
স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত
(১৮৫১-১৯২৬)